জাতীয় নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু হচ্ছে বিএনপির
এ মুহূর্তে বিএনপির সব মনোযোগ জাতীয় নির্বাচনের ওপর। আগামীকাল বৃহস্পতিবার দলের যে বর্ধিত সভা ডাকা হয়েছে, কার্যত সেখান থেকেই বিএনপির নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু হবে।
সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, সম্প্রতি বিভিন্ন মহল থেকে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে দাবি উঠেছে, সেটাকে খুব গুরুত্ব দেবে না বিএনপি; বরং দলটি জাতীয় নির্বাচনকে মুখ্য করেই পরবর্তী সাংগঠনিক কর্মসূচি তৈরির নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পবিত্র রমজান ও ঈদুল ফিতরের পরপরই নির্বাচনকেন্দ্রিক এ কর্মসূচি ও তৎপরতা শুরু হবে। আগামীকালের দলের বর্ধিত সভার মধ্য দিয়ে নির্বাচনমুখী কার্যক্রম শুরু হবে।
আগামীকাল জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হল প্রাঙ্গণে বিএনপির বর্ধিত সভা হবে। সভায় দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং মহানগর ও জেলার সব থানা, উপজেলা, পৌর কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক অথবা আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবেরা অংশ নেবেন।
এর বাইরে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলের চূড়ান্ত মনোনয়ন পাওয়া এবং মনোনয়নের জন্য প্রাথমিক চিঠি পাওয়া নেতারাও সভায় উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির এ বর্ধিত সভাকে ‘খুবই সময়োপযোগী’ বলে মনে করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ।
বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, সারা দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় সাড়ে তিন হাজার নেতাকে বর্ধিত সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ সভাকে একটা ‘যাত্রাবিন্দু’ বলে মন্তব্য করেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জহিরউদ্দিন স্বপন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘একদিকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা, অন্যদিকে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা প্রস্তাব—দুটি বিষয়কে গুছিয়ে বর্ধিত সভা থেকে একটি বার্তা দেওয়া হবে। বলতে পারেন, ওই সভা থেকে জাতীয় নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু করবে বিএনপি।’
এর আগে বিএনপির সর্বশেষ বর্ধিত সভা হয়েছিল ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার হোটেল লো মেরিডিয়েনের মিলনায়তনে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ৮ ফেব্রুয়ারি জেলে যাওয়ার চার দিন আগে অনুষ্ঠিত ওই সভায় দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সভাপতিত্ব করেন। সাত বছর পর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানামুখী আলোচনার মধ্যে বিএনপির এ বর্ধিত সভা হতে যাচ্ছে।
এ সভা আয়োজনের তদারক করছেন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে নির্বাচন নিয়ে তৃণমূলের নেতারা কী ভাবছেন, বর্ধিত সভা থেকে তার একটি ধারণা পাওয়া যাবে। সেই নিরিখে তৃণমূলকে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক নির্দেশনা দেওয়া হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গত ১৬ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জাতীয় নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়ের কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, অল্প সংস্কার করে নির্বাচন চাইলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে, আর আরেকটু বেশি সংস্কার করে নির্বাচন চাইলে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। বিএনপি ডিসেম্বরের ভোট ধরেই সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে।
কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সম্মেলনে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। মঙ্গলবার বিকেলে
বিএনপির নেতারা বলছেন, তাঁরা সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে ইতিমধ্যে দেশবাসীর সামনে দুটি বিষয় পরিষ্কার করেছেন। একটা হচ্ছে, জরুরি সংস্কারগুলো কী কী সেটা স্পষ্ট করা এবং এ ক্ষেত্রে সরকারকে সহযোগিতা করে দ্রুত নির্বাচন আদায় করা। এর বিনিময়ে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা। এরপর নির্বাচিত সরকারই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় বাকি সংস্কারগুলো সম্পন্ন করবে। এমন নীতিগত অবস্থান নিয়েই বিএনপি তার নির্বাচনী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের নেতা-কর্মীরা নির্বাচনমুখী হয়ে গেছে, জনগণ নির্বাচনমুখী হয়ে গেছে। মানুষ অপেক্ষা করছে নির্বাচনের জন্য।’
বিএনপি শুরু থেকেই নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট কিছু মৌলিক সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনের দাবি করে আসছে। বিএনপি ছাড়া বাম গণতান্ত্রিক জোট, ১২–দলীয় জোট, সমমনা জাতীয়তাবাদী জোটের শরিক দলগুলোও চলতি বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। তবে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ কিছু দল আগে প্রয়োজনীয় সংস্কার, তারপর নির্বাচন চায়। তারা আগে স্থানীয় নির্বাচন করারও পক্ষে। অন্যদিকে বিএনপিসহ স্বৈরাচারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের শরিকেরা আগে জাতীয় নির্বাচনের পক্ষে।
নানা দাবিতে ঢাকার ধামরাইয়ে ঢাকা জেলা বিএনপি আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য দেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
এ ছাড়া গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে। তারা একাধিকবার এ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে বক্তব্য দিয়েছে এবং সংস্কার করেই নির্বাচনের কথা বলেছে।
ফলে স্থানীয় নাকি জাতীয়—কোন নির্বাচন আগে হবে, ভোটের আগে সংস্কার কতটা হবে বা নির্বাচিত সরকার কী কী সংস্কার করবে—এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রকাশ্য মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। গত শনিবার চাঁদপুরে এক সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, জনদুর্ভোগ নিরসনের জন্য স্থানীয় নির্বাচন দিতে হবে। স্থানীয় নির্বাচন হলেই জনগণের এ দুর্ভোগ কাটবে। এরপর অবশ্যই জাতীয় নির্বাচনও দিতে হবে। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে জনগণ কিছু মৌলিক সংস্কার চায়।
যদিও আগে স্থানীয় নির্বাচনের চিন্তাকে নাকচ করে দিয়েছে বিএনপি। তারা মনে করে, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে গেলে সারা দেশে সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এটাকে চক্রান্ত হিসেবেও দেখছে তারা। এমনকি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের চেষ্টা হলে বিএনপির নীতিনির্ধারণী কোনো কোনো নেতা প্রতিহত করারও ঘোষণা দিয়েছেন।
কোন মন্তব্য নেই