রমজানে কমেছে বেশিরভাগ পণ্যের দাম
২০২৪ সালের রোজার শুরুতে খুচরায় প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হয় মানভেদে ৯০ থেকে ১১০ টাকায়। এবার সেই পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। সে হিসাবে রমজানের বাজারে আগের বছরের তুলনায় পেঁয়াজের দাম কমেছে ৫৪ শতাংশ।
শুধু পেঁয়াজ নয়, এমনিভাবে গত বছরের তুলনায় এবার খেজুর, চিনি, মুরগির মাংস, ডিম ও শাকসবজি-তরিতরকারিসহ বেশকিছু ভোগ্যপণ্যের দাম কমেছে। গত রমজানের ১৫০ টাকার চিনি এবার ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সব মিলেই সয়াবিন তেল ও চাল ছাড়া সব পণ্যের সরবরাহ ও দামের বিষয়ে ভোক্তাদের মধ্যে একধরনের স্বস্তি বিরাজ করছে।
গত বছরের ৪০ টাকার আলু এবার বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ টাকায়। মুরগির ডিম ও মাংসের দামও কমেছে। গত বছর যে ডিম প্রতি হালি বিক্রি হতো ৪৩ থেকে ৪৫ টাকায়, এবার সেই ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। ডিম ব্যবসায়ী আল-আমিন বলেন, রমজানে সামনে ডিমের দাম আরো কমতে পারে।
আগের বছরের তুলনায় ৩০ থেকে ৪০ টাকা কমে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায়। লেয়ার মুরগি ৩০০ টাকার বদলে ২৮০ এবং সোনালি কক ২৮০ টাকার বদলে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে দেশি মুরগি ও হাঁসের দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। দেশি মুরগি ৫৫০ এবং হাঁস ৭০০ টাকা কেজি ধরে বিক্রি হচ্ছে।
গত বছরের তুলনায় অধিকাংশ ভোগ্যপণ্যের দাম কমলেও সরুজাতের চাল ও সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে। দেড় মাসের বেশি সময় ধরে সয়াবিন তেলের সংকটে দিশাহারা সাধারণ ভোক্তারা। বেশি দাম দিয়েও বোতলের সয়াবিন তেল পাচ্ছেন না ভোক্তারা।
ইসমাইল নামে তিতাসের এক কর্মকর্তা কারওয়ান বাজার থেকে ৫ লিটারের সয়াবিন তেল নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। তিনি বলেন, কয়েক দোকান ঘুরে একটি বোতল পেয়েছি। সয়াবিনের বোতল পাওয়া মানে সোনার হরিণের মতো। এ সুযোগে বিক্রেতারা খোলা তেল উচ্চদামে বিক্রি করছেন।
এদিকে কয়েক দফা চালের দাম বাড়ার পর রমজানের শুরুতেও বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে। সরুজাতের মিনিকেট চালের দাম গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বলে জানান ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে ভালো মানের মিনিকেট চাল মানভেদে ৭৯ থেকে ৮৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মোটা স্বর্ণা গুটিচাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকায়।
এদিকে পাইকারি বাজারের তুলনায় খুচরায় বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ছোলা। পাইকারি বাজারের দামের অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিয়ে খুচরা ব্যবসায়ীরাও বাড়তি মুনাফা করছেন। রোজার মাঝামাঝিতে চাহিদা কমে যাওয়ার আগে মানুষের চাহিদা ও বাজার তদারকির অভাবে বাড়তি মুনাফার আশায় আমদানিকারক থেকে শুরু করে খুচরা পর্যায়েও মজুত করে অতিরিক্ত মুনাফা করছেন ব্যবসায়ীরা। এরপরও গত বছরের তুলনায় এবার ৫ থেকে ১০ টাকা কমে ছোলা বিক্রি হচ্ছে।
রমজানে রোজাদারদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভোগ্যপণ খেজুর। এবার এনবিআরের পক্ষ থেকে রমজান মাসে খেজুরকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য আমদানির ওপর বিদ্যমান কাস্টমস শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ এবং বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়। অর্থাৎ মোট করহার ৬৩ দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৮ দশমিক ৭০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। আর এনবিআরের এ সিদ্ধান্তের ফলেই খুচরা বাজারে কমেছে খেজুরের দাম।
গত বছর সাধারণ জাতের যে খেজুর ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা বিক্রি হতো, এবার তা ১৮০ টাকা থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে খুচরা বাজারে মিদজুল, আজোয়া ও মরিয়ম জাতের খেজুরের দাম যে যেমন পারছে, সেভাবেই উচ্চমূল্যে বিক্রি করছেন উচ্চবিত্তদের কাছে।
তেজতুরি বাজারের নাজমা বেগম নামে এক ক্রেতা কারওয়ান বাজার মসজিদের পাশের দোকান থেকে এক কেজি বাংলা খেজুর কেনেন ১৮০ টাকায়। তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় এবার খেজুরের দাম কিছুটা হলেও কম। সরবরাহও বেশ ভালো। বাজারে খেজুরের কোনো হাহাকার নেই।
শসা ও লেবুর দামও গত বছরের তুলনায় কম লক্ষ করা গেছে। গত বছর প্রথম রমজানে শসা বিক্রি হয়েছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। এবার তা ৫০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ক্ষিরার দামও গত বছরের তুলনায় কম। গতবছর যে ক্ষিরা ৭০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হতো, বর্তমানে তা ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। সপ্তাহখানেক আগে যে লেবুর দাম ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা হালি, ২-৩ দিনের ব্যবধানে তা ৬০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এরপরও গত বছরের তুলনায় ২০ থেকে ৩০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে লেবু।
এদিকে গত বছরের তুলনায় এবারের রমজানে কাঁচা সবজি ও তরিতরকারির দাম ক্রেতার নাগালেই রয়েছে। রমজান উপলক্ষে দাম বাড়লেও গত বছরের তুলনায় অনেক কম। গত বছর যেখানে ১০০ টাকা কেজি কাঁচা মরিচ বিক্রি হতো, এবার তা ৬০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গাজর ৫০ টাকার স্থলে এবার ২০ থেকে ২৫ টাকা, বেগুন ১০০ টাকার বদলে ৫০ থেকে ৭০, শিম ৩০-৪০, ফুলকপি ২০, টমেটো ২০ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
মাছ-মাংসের দাম রমজান উপলক্ষে বাড়লেও গতবারের তুলনায় সহনীয় মাত্রায় রয়েছে। মাছের দাম আগের বছরের তুলনায় কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে। তেলাপিয়া ২০০, পাঙাশ ২২০, রুই আকারভেদে ২৮০ থেকে ৫০০, কাতল আকারভেদে ৩০০ থেকে ৭০০, পাবদা ৪০০, বোয়াল আকারভেদে ৫৫০ থেকে এক হাজার, বেলে ৫৫০, বড় শোল ৭৫০, মাগুর ৭০০, বাটা ৫৫০ ও দেশি টেংরা ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
গরুর মাংস গত বছর ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা কেজি ধরে বিক্রি হলেও এবার ৭৫০ থেকে ৭৭০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। তবে খাসির মাংসের দাম এবার কেজিতে ৫০ টাকা বেড়ে ১১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে অভিজাত এলাকায় এরচেয়েও বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
রমজান মাসে ফলের দামও সহনীয় রয়েছে বলছেন ক্রেতা ও বিক্রেতারা। তবে রমজানের শুরুর দিকে কিছুটা উত্তাপ থাকলেও ধীরে ধীরে কমে আসবে।
বছরের শুরু থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, রমজানে বাজারে সবকিছুর দাম স্থিতিশীল থাকবে। এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিদপ্তর একাধিক বৈঠকও করেছে ব্যবসায়ীদের নিয়ে। এসব বৈঠক থেকে আশ্বাসও এসেছে, কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না পবিত্র রমজান সামনে রেখে। এছাড়া টিসিবির মাধ্যমে স্মার্টকার্ড ও ট্রাকসেলের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করাসহ সরকারের নানা ইতিবাচক পদক্ষেপে এবার মাহে রমজানে বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম সহনীয় রয়েছে বলে মনে করেন ক্রেতা ও বিক্রেতারা।
কোন মন্তব্য নেই