মানুষের জীবনের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা মানসিক প্রশান্তি। মানসিক শান্তি নিয়ে উক্তি: ইসলাম ও কোরআনে আছে। আমরা প্রতিনিয়ত নানা কাজ, সংগ্রাম ও সাধনায় লিপ্ত হই, কিন্তু আমাদের সেই সাধনার অন্তিম লক্ষ্যই হলো আত্মার তৃপ্তি ও প্রশান্তি। আজকের জগতব্যাপী উন্নত জীবনমান, প্রযুক্তি ও বিলাসিতার ছড়াছড়ি সত্ত্বেও মানুষ মানসিক অস্থিরতায় ভুগছে। কেন? কারণ, আত্মিক প্রশান্তির উৎস আসলে বাইরের কিছু নয়, বরং অন্তরের গভীরে এক আধ্যাত্মিক সংযোগের মধ্যে লুকায়িত।
✦ মানসিক প্রশান্তির মূল উৎস: আল্লাহর স্মরণ
আল-কুরআনে আল্লাহ বলেন:”যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণে শান্ত হয়; জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণেই অন্তরসমূহ প্রশান্ত হয়।”
— (সূরা রা’দ, ১৩:২৮)
এই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, অন্তরের প্রশান্তি অর্জন হয় একমাত্র আল্লাহর স্মরণ বা “যিকির”-এর মাধ্যমে। বাহ্যিক অর্জন চিরস্থায়ী শান্তি দিতে পারে না, কারণ তা হৃদয়ের গভীর চাহিদা পূরণে ব্যর্থ।
✦ কুরআন: আত্মিক প্রশান্তির মাধ্যম
আল্লাহ বলেন:”এই কুরআন এমন এক পথপ্রদর্শক যা সবচেয়ে সঠিক পথে পরিচালিত করে এবং যারা সৎ কাজ করে তাদের জন্য রয়েছে মহান প্রতিদান।”
— (সূরা ইসরা, ১৭:৯)
কুরআন শুধু ধর্মীয় অনুশাসন নয়, বরং মানুষের জীবনব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা। এটি হৃদয়ের অশান্তি দূর করে আল্লাহর ভালোবাসায় মনকে পূর্ণ করে।
✦ দুনিয়ার প্রাচুর্য কি প্রশান্তি দেয়?
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন:”মানুষের যদি একটি উপত্যকা পরিমাণ সম্পদ থাকে, তবে সে আরেকটি চায়। যতক্ষণ না তার পেট মাটি দিয়ে ভর্তি হয় (অর্থাৎ মৃত্যু না আসে), ততক্ষণ সে সন্তুষ্ট হয় না।”
— (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৬৪৩৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১০৪৮)
এই হাদীসের মাধ্যমে বোঝা যায়, দুনিয়ার সম্পদ কখনোই মানুষের মনকে পরিতৃপ্ত করতে পারে না। অন্তরের প্রশান্তি বাহ্যিক অর্জনে নয়, বরং ঈমান ও আল্লাহর প্রেমে নিহিত।
✦ সাহাবীদের জীবন: এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
সাহাবীগণ ছিলেন এমন এক প্রজন্ম, যারা কুরআনের আলোয় আলোকিত হয়ে দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে আল্লাহর ভালোবাসায় আত্মা পূর্ণ করেছিলেন। তাঁরা দারিদ্র্য, কষ্ট, নিপীড়ন—সবকিছুর মাঝেও প্রশান্তিতে ছিলেন। তাঁদের শক্তি ছিল এই আত্মিক সংযোগ।
“তারা (সাহাবীরা) এমন এক জাতি ছিলেন, যারা কুরআনকে কেবল মুখে পাঠ করতেন না, বরং হৃদয়ে ধারণ করতেন ও জীবনে বাস্তবায়ন করতেন।”
প্রকৃত মানসিক প্রশান্তি ধন-সম্পদ, খ্যাতি কিংবা বাহ্যিক সৌন্দর্যে নেই। এটি নিহিত হৃদয়ের গভীরে—আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, কুরআনের আলো এবং রাসূল ﷺ এর অনুসরণে।
নিয়মিত কুরআন পাঠ করা ও তা উপলব্ধি করা,আল্লাহর স্মরণে মনকে ব্যস্ত রাখা,এবং দুনিয়ার মোহ থেকে নিজেকে দূরে রেখে আত্মিক প্রশান্তির দিকে অগ্রসর হওয়া।
মানসিক শান্তি নিয়ে উক্তি: তার পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
প্রশান্ত আত্মা সেই সৌভাগ্যবান আত্মা, যা তার রবের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। এই আত্মা পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়ী সুখের চেয়ে আখেরাতের চিরন্তন সুখের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় পূর্ণ থাকে এবং তার জাগতিক জীবন আখেরাতকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়।
প্রকৃত প্রশান্ত আত্মা তার মহান প্রতিপালকের যেকোনো ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকে, এমনকি যদি তা জীবনের কঠিনতম মুহূর্তও হয়। সে ঐ বিপদকে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা কল্যাণকর সিদ্ধান্ত হিসেবে সানন্দে গ্রহণ করে। যে হৃদয় মহান আল্লাহর ইবাদতে গভীরতম আনন্দ অনুভব করে, যে অন্তর তাঁর একত্ববাদ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় এবং যে জানে যে তার রিজিকের একমাত্র মালিক আল্লাহ এবং তাঁর উপর অবিচল আস্থা রাখে – সেটাই প্রশান্ত হৃদয়।
মৃত্যুর সময় এই আত্মাকে সম্বোধন করে বলা হয়: “يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ، ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً” । অর্থাৎ, “হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার রবের দিকে ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন অবস্থায়।” (ফাজর ৮৯/২৭-২৮)
হাসান বছরী (রহঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, “আল্লাহ যখন কোনো মুমিন বান্দার রুহ কবজ করতে চান, তখন সেই রুহ আল্লাহর দিকে ধাবিত হয়ে শান্তি লাভ করে এবং আল্লাহও তার প্রতি সন্তুষ্ট হন।”
আলী ত্বানত্বাবী (রহঃ) বলেন, “প্রশান্ত আত্মা হলো সেই আত্মা, যা তার খাঁটি ঈমান ও সৎকর্মের বদৌলতে কিয়ামতের দিনের যাবতীয় ভয় ও দুশ্চিন্তা থেকে নিরাপদ থাকবে।”
এছাড়াও, আল্লাহর শাস্তির ভয়ে সর্বদা ভীত থাকা প্রশান্ত আত্মার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
এই আত্মা তার প্রভুর সন্তুষ্টি লাভ করে এবং নিজেও তার প্রভুর দেওয়া সকল সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকে। সে সুখে-দুঃখে সর্বদা তার রবকে স্মরণ করে, বিপদে ধৈর্য ধারণ করে এবং নিয়ামত লাভ করলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এই পবিত্র আত্মা যখন দেহ ত্যাগ করে, তখন ফেরেশতারা তাকে আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করে।
তার সুগন্ধে আকাশ সুরভিত হয় এবং ঊর্ধ্বলোকে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে তাকে ‘ইল্লিয়্যিন’ নামক সর্বোচ্চ মর্যাদার স্থানে রাখা হয় (মুত্বাফফিফীন ৮৩/১৯)। তার কবর আলোকিত করা হয় এবং সেখানে জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দেওয়া হয়। কিয়ামত পর্যন্ত তার কাছে জান্নাতের সুঘ্রাণ পৌঁছাতে থাকে।
কতই না ভাগ্যবান সেই হৃদয়ের অধিকারীরা! দুনিয়া ও আখেরাতে এই অন্তরের চেয়ে মূল্যবান আর কী হতে পারে? এই অন্তরের মালিকের চেয়ে সফল আর কেই বা হতে পারে? সে তার প্রিয় রবের ভালোবাসায় এতটাই মগ্ন থাকে যে, পার্থিব কোনো কিছুর প্রতি তার সামান্যতম আকর্ষণও থাকে না।
এমনকি তার প্রিয়তম স্ত্রী, পিতা-মাতা, ভাই-বোন ও আদরের সন্তানদের ছেড়ে যেতেও সে দ্বিধা বা আফসোস করে না। আল্লাহর ভালোবাসার প্রতি মানব হৃদয়ের এই তীব্র আকর্ষণই হলো প্রশান্ত আত্মার মূল বৈশিষ্ট্য। আর এই আত্মার অধিকারী হওয়ার জন্য কুরআনই হবে সর্বোত্তম পথপ্রদর্শক।
মানসিক শান্তি নিয়ে উক্তি দিয়ে আত্মার শান্তি অর্জনে কুরআনের ভূমিকা
কুরআনের মাধ্যমে মানব হৃদয়ে যে অনাবিল শান্তি লাভ হয়, তা স্বয়ং মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর পবিত্র কালামের বিভিন্ন স্থানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর জীবনে এর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি দেখিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কিছু আলোকপাত করা হলো:
কুরআন তেলাওয়াত শুধু একটি ইবাদতই নয়, এটি সর্বোত্তম যিকিরেরও অন্তর্ভুক্ত। অন্যান্য যিকিরের মাধ্যমে বান্দা যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কৃত হয়, তেমনি কুরআন পাঠকারীও মহান আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহ লাভ করে। আর এর সবচেয়ে বড় প্রতিদান হলো অন্তরের প্রশান্তি। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন:
“الَّذِينَ آَمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُمْ بِذِكْرِ اللهِ أَلَا بِذِكْرِ اللهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ”
(আর-রাদ ১৩/২৮)
অর্থাৎ, “যারা ঈমান এনেছে এবং আল্লাহর স্মরণে যাদের অন্তর প্রশান্ত হয়। জেনে রাখো, আল্লাহর স্মরণেই অন্তরসমূহ শান্তি লাভ করে।”
ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) বলেন, “এখানে আল্লাহর যিকির বলতে কুরআনকেই বোঝানো হয়েছে। এটি মহান আল্লাহর সেই যিকির, যা তিনি তাঁর রাসূলের উপর অবতীর্ণ করেছেন। এর মাধ্যমেই মুমিনদের হৃদয় শান্তি লাভ করে। কারণ ঈমান ও ইয়াকীন ছাড়া হৃদয় প্রশান্ত হয় না। আর কুরআন ছাড়া ঈমান ও ইয়াকীন অর্জনের অন্য কোনো পথ নেই।”
এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, মানসিক প্রশান্তির জন্য ঈমান ও ইয়াকীন উভয়ই অপরিহার্য, আর এই উভয়বিধ গুণ অর্জিত হয় কুরআনের মাধ্যমে। যদিও ঈমান ও ইয়াকীনের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান। হযরত আলী (রাঃ) বলেন, “ইয়াকীন হলো তুমি স্বচক্ষে যা দেখে বিশ্বাস করো। আর ঈমান হলো তুমি নিজ কানে শুনে যা বিশ্বাস করো এবং তা সত্য বলে মেনে নাও।”
বস্তুত, এই ঈমান যখন দৃঢ় ও মজবুত হয়, তখন তা ইয়াকীনে রূপান্তরিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, আমরা আল্লাহ, আখেরাত ও রাসূল (সাঃ)-কে না দেখেই বিশ্বাস স্থাপন করেছি। কিন্তু কুরআন ও হাদিসের মাধ্যমে আমাদের সেই বিশ্বাস ইয়াকীনে পরিণত হয়েছে এবং আমাদের হৃদয় প্রশান্ত হয়েছে। এ কারণেই হাফেজ ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) বলেন, “বিশ্বাসযোগ্য কোনো সংবাদ শোনার পর হৃদয়ের যে প্রশান্তি লাভ হয়, তাকেই ইয়াকীন বলা হয়।” হাফেজ ইবনু রজব হাম্বলী (রহঃ) আরও বলেন, “কেবল ঈমানের মাধ্যমেই মানসিক শান্তি লাভ করা সম্ভব।” আর নিঃসন্দেহে কুরআনের মাধ্যমেই ঈমান বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا”
(আল-আনফাল ৮/২)
অর্থাৎ, “আর যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করা হয়, তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে।” আর এই ঈমানের বরকতেই তারা মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে সক্ষম হয়। অন্যত্র মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন:
“يَاأَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُم مَّوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَشِفَاء لِّمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّلْمُؤْمِنِينَ”
(ইউনুস ১০/৫৭-৫৮)
অর্থাৎ, “হে মানবজাতি! তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে এসেছে উপদেশ (কুরআন), অন্তরের রোগের নিরাময় এবং মুমিনদের জন্য পথপ্রদর্শক ও রহমত।”
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, “এই আয়াতে ‘রহমত’ বলতে কুরআনকেই বোঝানো হয়েছে।” ইবনুল খাত্তীব (রহঃ) বলেন, “কুরআন হলো অন্তরের রোগের শিফা। আর অন্তরের রোগ শারীরিক রোগের চেয়েও ভয়াবহ। কারণ বিশুদ্ধ ঈমান থাকলে শারীরিক রোগও বান্দাকে জান্নাতে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু অন্তরের রোগ মানুষকে জাহান্নামের দিকে ধাবিত করে। জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো হৃদয়ের সুস্থতা। আর হৃদয় তখনই সুস্থ হয়, যখন তা যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি ও কলুষতা থেকে মুক্ত থাকে। আর সেই অন্তরকে সুস্থ রাখার সবচেয়ে উপযুক্ত হাতিয়ার হলো কুরআন। যা হৃদয়কে যাবতীয় অসুস্থতা ও পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করে চিরস্থায়ী সুখ ও শান্তির জীবন দান করে।”
ইবনু কাছীর (রহঃ) কুরআন পরিত্যাগকারীর অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “যে ব্যক্তি কুরআনকে পরিত্যাগ করে, দুনিয়াতে তার জন্য কোনো মানসিক শান্তি বা প্রফুল্লতা নেই। বিপথগামীতার কারণে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। বাহ্যিকভাবে সে প্রাচুর্যপূর্ণ জীবন যাপন করলেও – যখন যা চায় খেতে পারলেও, যে পোশাক ইচ্ছে পরতে পারলেও, যেখানে খুশি যেতে পারলেও – যদি তার হৃদয় হেদায়েত ও ঈমানের ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়, তাহলে তার মন সর্বদা সন্দেহ, দুশ্চিন্তা ও পেরেশানিতে নিমজ্জিত থাকে। আর এই মানসিক প্রশান্তিবিহীন জীবনই সবচেয়ে কষ্টের জীবন।”
কুরআনের মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি লাভের উপায়
অন্তরের শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনের এক শক্তিশালী মাধ্যম হলো কুরআন। এর মাধ্যমে আমরা কিভাবে মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে পারি, তা কয়েকটি ধাপে আলোচনা করা হলো:
অর্থ অনুধাবন করে কুরআন তেলাওয়াত:
কুরআন শুধু একটি পঠিতব্য গ্রন্থ নয়, বরং এটি জীবন চলার পথের দিশা। এর প্রতিটি আয়াতের গভীর অর্থ উপলব্ধি করার মাধ্যমেই কুরআনের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ অনুধাবন করা সম্ভব। দুঃখের বিষয় হলো, আমরা পার্থিব লাভের আশায় কত ভাষা শিখি, কিন্তু কুরআন বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় ভাষাজ্ঞান অর্জনে তেমন গুরুত্ব দেই না। অথচ, যদি কেউ কুরআনের মাধ্যমে মানসিক শান্তি পেতে চায়, তবে এর অর্থ বুঝে তেলাওয়াত করা অপরিহার্য। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের বহু স্থানে এর আয়াত নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,
‘‘এটি এক বরকতমন্ডিত কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি। যাতে লোকেরা এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং জ্ঞানীরা উপদেশ গ্রহণ করে’ (ছোয়াদ ৩৮/২৯)।
আল্লাহ আরো বলেন,
‘তবে কি তারা কুরআন গবেষণা করে না? নাকি তাদের হৃদয়গুলি তালাবদ্ধ’? (মুহাম্মাদ ৪৭/২৪)।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘তোমরা কবিতার মতো দ্রুত কুরআন পাঠ করো না এবং এটাকে নষ্ট খেজুরের মতো ছিটিয়ে দিয়ো না। এর আশ্চর্য বিষয় নিয়ে একটু ভাবো। কুরআন দিয়ে দিলকে একটু নাড়া দাও। (তেলাওয়াতের সময়) সূরা শেষ করাই যেন তোমাদের একমাত্র চিন্তা না হয়’। শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহঃ) বলেন,
‘না বুঝে অনেক বেশী কুরআন তেলাওয়াত করার চেয়ে চিন্তা-ভাবনা করে অল্প তেলাওয়াত করা অতি উত্তম’। যখন কোন বান্দা কুরআন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে এবং এর বিধানাবলী বোঝার চেষ্টা করে, তখন এর প্রভাব তার হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করে। এই প্রভাবের মাধ্যমেই সে মানসিক প্রশান্তি লাভ করে।
সাকীনাহর আয়াত তেলাওয়াত বা শ্রবণ:
কুরআন মাজীদে কিছু বিশেষ আয়াত রয়েছে যা ‘সাকীনাহর আয়াত’ নামে পরিচিত। ‘সাকীনাহ’ শব্দের অর্থ হলো আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ এক ঐশ্বরিক মানসিক প্রশান্তি। মানসিক শান্তি অর্জনে এই আয়াতগুলোর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়া (রহঃ) বলেন, ‘শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ (রহঃ) যখন কোনো কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেন, তখন সাকীনাহর আয়াতগুলো তেলাওয়াত করতেন’। অসুস্থতা, অক্ষমতা, উদ্বেগ, ভয়, শয়তানের কুমন্ত্রণা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তিনি এই আয়াতগুলো পাঠ করতেন এবং বলতেন, ‘যখন কোনো কঠিন পরিস্থিতি আমাকে ঘিরে ফেলে, তখন আমি আমার আত্মীয়-স্বজন বা আশেপাশের কাউকে বলি, আমাকে সাকীনাহর আয়াতগুলো পড়ে শোনাও। এরপর (আয়াতগুলো শুনে) সেই কঠিন অবস্থা দূর হয়ে যায় এবং আমার অন্তর শান্তিতে ভরে ওঠে’। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) আরো বলেন,
‘আমি নিজেও মনের অস্থিরতা ও অশান্তির মুহূর্তে এই আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে দেখেছি এবং এর মাধ্যমে আমার অন্তরে গভীর শান্তি ও স্থিরতা অনুভব করেছি’। সুতরাং, সাকীনাহর আয়াত তেলাওয়াত করে অথবা শুনে আমরা আমাদের হৃদয়কে শান্ত করতে পারি।
মনোযোগের সাথে কুরআন তেলাওয়াত শ্রবণ
পবিত্র কুরআন মহান আল্লাহ তা‘আলার এক অনন্য মু‘জেযা। মনোযোগ দিয়ে কুরআন শ্রবণ করলেও মানুষের অন্তর নরম হয় এবং এক অপার্থিব শান্তি অনুভূত হয়। এই কুরআন শুনে বহু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছেন। কাফেরদের অন্তর সাধারণত অশান্ত ও হতাশায় পরিপূর্ণ থাকে, কিন্তু তাদের অনেকেই কুরআন শুনে শান্ত হয়েছেন এবং ইসলামের পথে এসেছেন। রাসূল (ছাঃ)-এর যুগ থেকে শুরু করে আজও এমন ঘটনা ঘটছে। মক্কার কাফের মুশরিকরা অন্যদের কুরআন শুনতে বাধা দিত। তারা বলত, ‘তোমরা এই কুরআন শ্রবণ করো না এবং এর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ো না’ (ফুছছিলাত ৪১/২৬)। তাদের ধারণা ছিল, কুরআনের মোহনীয় শক্তি মানুষকে মুহাম্মাদের (ছাঃ) ধর্মে আকৃষ্ট করবে। অথচ, তারাই গোপনে রাতের অন্ধকারে রাসূল (ছাঃ)-এর তাহাজ্জুদের সালাতের তেলাওয়াত শুনত। আবু সুফিয়ান, নযর বিন হারেছ, আখনাস বিন শারীক্ব, আবু জাহল প্রমুখ নেতারা একে অপরের অগোচরে এই কাজ করত (ইবনু হিশাম ১/৩১৫-১৬)। কিন্তু যখন তারা জনসমক্ষে যেত, তখন তাদের বক্তব্য পাল্টে যেত।
তুফায়েল ইবনু আমের আদ-দাওসী (রাঃ) এর ঘটনা এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তিনি মক্কায় এসে কুরায়েশ নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করলে তারা তাঁকে মুহাম্মাদের (ছাঃ) কথা শোনা থেকে বিরত থাকতে বলেন, কারণ তাদের ভয় ছিল তুফায়েল (রাঃ) তাঁর যাদু প্রভাবিত কথায় পথভ্রষ্ট হয়ে যাবেন। কিন্তু পরবর্তীতে তুফায়েল (রাঃ) নিজেই রাসূল (ছাঃ)-এর কুরআন তেলাওয়াত শুনে মুগ্ধ হন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন।
কুরআন শ্রবণ এতটাই শক্তিশালী যে, রাসূল (ছাঃ) নিজেও অন্যের তেলাওয়াত শুনতে ভালোবাসতেন। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাঃ) তাঁকে কুরআন তেলাওয়াত করে শোনাতে বলেন। মাসঊদ (রাঃ) বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনাকে কুরআন শোনাবো, অথচ তা আপনার উপরই নাযিল হয়েছে?’ রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আমি অন্যের কাছ থেকে কুরআন শুনতে বেশি পছন্দ করি’। এরপর যখন মাসঊদ (রাঃ) সূরা নিসা তেলাওয়াত করতে করতে একটি বিশেষ আয়াতে পৌঁছালেন, তখন রাসূল (ছাঃ)-এর দুই চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে (বুখারী ৫০৪৯)।
ইসমাঈল আস্ফাহানী (রহঃ) বলেন, আরবে রাসূল (ছাঃ)-এর অনেক শত্রু ছিল যারা তাঁকে হত্যার জন্য ওঁৎ পেতে থাকত, কিন্তু কুরআন তেলাওয়াতের মধুর ধ্বনি তাদের অন্তরে এমন পরিবর্তন আনত যে, তারা তাৎক্ষণিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করত এবং তাদের শত্রুতা বন্ধুত্বে পরিণত হতো।
ইতালির বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী রোকসানা ইলিনা নেগ্রা ইসলাম গ্রহণের পর বলেন, ‘আমি পবিত্র কুরআন অধ্যয়ন করেছি। যতই পড়েছি, ততই আমি মুগ্ধ হয়েছি। এই মুগ্ধতা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমি মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে সর্বদা প্রশান্তির উৎস খুঁজেছি এবং অবশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, ইসলামেই রয়েছে জীবনের সকল সমস্যার সঠিক সমাধান’। এই সকল ঘটনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, কুরআন শ্রবণের মাধ্যমেও মানব হৃদয় গভীর শান্তিতে ভরে উঠতে পারে।
নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত:
কুরআনের মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি লাভের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো প্রতিদিন কিছু সময় কুরআন তেলাওয়াতের জন্য নির্ধারণ করা। নিয়মিত তেলাওয়াতের মাধ্যমে হৃদয়কে সজীব রাখা যায়। তেলাওয়াতের সময় যখন গভীর অর্থবোধক আয়াতগুলো বারবার পাঠ করা হয়, তখন অন্তর আরো বেশি প্রভাবিত হয়। ইসহাক ইবনে ইবরাহীম (রহঃ) বলেন, ‘ফুযাইল ইবনে ইয়ায (রহঃ) দুঃখভারাক্রান্ত, আবেগপূর্ণ ও ধীরস্থিরভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতেন। মনে হতো যেন তিনি কারো সাথে কথা বলছেন। যখন তিনি জান্নাতের আলোচনার কোনো আয়াতের কাছে পৌঁছাতেন, তখন সেটি বারবার তেলাওয়াত করতেন’।
মালেক ইবনু দীনার (রহঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের কথার পরিবর্তে আল্লাহর কালামের সাথে পরিচিত হতে পারে না, তার জ্ঞান হ্রাস পায়, অন্তর অন্ধ হয়ে যায় এবং সে তার জীবনকে বৃথা করে’। সুতরাং, অধিকাংশ সময় অনর্থক আলোচনায় লিপ্ত না থেকে যে হৃদয় আল্লাহর স্মরণে মশগুল থাকে, সেই হৃদয়ই প্রকৃত শান্তির সন্ধান পায়। আফসোস! আমরা প্রায়শই অন্যের দোষচর্চায় মূল্যবান সময় নষ্ট করি, কিন্তু কুরআন পড়ার সময় পাই না। ফলে মানসিক শান্তি আমাদের নাগালের বাইরে থেকে যায়।
পরিশেষে বলা যায়, কুরআনের মাধ্যমেই আল্লাহ তা‘আলা মুসলিম উম্মাহর মর্যাদা সমুন্নত করেছেন। এই কুরআনের মধ্যেই বান্দার জন্য সকল প্রকার কল্যাণ নিহিত রয়েছে। যখন কারো উপর পৃথিবী সংকীর্ণ হয়ে আসে, সুখের সকল দরজা বন্ধ হয়ে যায়, কাছের মানুষের বিশ্বাসঘাতকতায় হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়, একাকীত্ব গ্রাস করে, দুশ্চিন্তা ও হতাশার কালো মেঘ অন্তরাত্মাকে আচ্ছাদিত করে, অথবা সরল পথের অনুসন্ধানী ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন কুরআনের শরণাপন্ন হওয়াই একমাত্র সমাধান। যে কুরআনকে যত বেশি আপন করে নেবে, কুরআন তাকে তত বেশি মানসিক শান্তি এনে দেবে—ইনশাআল্লাহ। আসুন, আমরা আমাদের জীবনকে অহীর আলোয় আলোকিত করি এবং জীবনের সকল হতাশা ও পেরেশানি দূরীকরণে কুরআনকে নিজেদের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করি। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন—আমীন!