সুবিধাবাদী ও নব্য নেতাদের দৌরাত্ম্যে বিএনপির নেতাকর্মীরা অতিষ্ঠ। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত এদের অপতৎপরতা চলছে। গত সাত মাসে দল তিন হাজারের বেশি নেতাকর্মীর পদ স্থগিত ও বহিষ্কার করেছে। তবে কিছু তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও রহস্যজনক কারণে বহিষ্কার করা হচ্ছে না। এতে দলের ত্যাগী ও যোগ্য নেতারা আরও পিছিয়ে পড়ছেন।
বর্তমানে, অন্য দল থেকে আসা বা সুবিধাবাদী শ্রেণির লোকেরা দলের সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করছে। অভিযোগ রয়েছে, এরা গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে ব্যবসা, টেন্ডারবাজি সহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। বিএনপির রাজনীতিতে এদের কোনো ভূমিকা না থাকলেও এখন তারাই দলের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে।
জানা গেছে, ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এই হাইব্রিড ও সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা দখল, টেন্ডার ও চাঁদাবাজির মতো নানা অপকর্মে জড়িত। দলের দায়িত্বশীল নেতারা এসব ঘটনার তদন্তে প্রায়শই হাইব্রিড বা টাউট-বাটপার শ্রেণির ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছেন। অথচ এসব অপকর্মের দায় চাপানো হচ্ছে বিএনপির পুরনো নেতাকর্মীদের ওপর। এই পরিস্থিতিতে দলের ত্যাগী ও দুঃসময়ের সাথীরা চরম অস্বস্তিতে পড়েছেন।
দলীয় সূত্রে খবর, কেন্দ্র থেকে এবার এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দোষী ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি আইনি পদক্ষেপও নেওয়া হবে। বর্তমানে বিএনপিতে ‘হাইব্রিড’দের দাপট খুব বেশি। ঢাকা থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা পর্যন্ত সব স্তরেই তাদের দাপট চরমে। অথচ এরা কোনোদিনই আন্দোলন-সংগ্রামে বা সাংগঠনিক কার্যক্রমে ছিল না। এখন তারা ঢাকায় যোগাযোগ করে কেন্দ্র থেকে কমিটি বাগিয়ে গ্রামে যাচ্ছে। এদের কারণে দলের দীর্ঘদিনের ত্যাগী নেতাকর্মীরা হতাশ ও কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন।
যদিও বিএনপির হাইকমান্ড ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের শুরু থেকেই হাইব্রিড নেতাদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যাতে হাইব্রিডদের দলে জায়গা না দেওয়া হয় এবং দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যাদের বিরুদ্ধে অপকর্মের অভিযোগ উঠেছে, তদন্তে প্রমাণিত হলে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে। তবুও সুবিধাবাদী ও হাইব্রিড নেতাদের দাপট থামানো যাচ্ছে না।
কেন্দ্রীয় দপ্তর জানিয়েছে, গত সাত মাসে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের তিন হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি ১৮০০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এদের মধ্যে ৭৫০ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ, ৮০০ জনকে বহিষ্কার, ৫০ জনের পদ স্থগিত, অন্তত ১০০ জনকে সতর্ক এবং ১৫০ জনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল ৪০০ জনকে বহিষ্কার ও ৬০০ জনের বেশি নেতাকর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক দলের অন্তত ১০০ জনকে বহিষ্কার ও ১৫০ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। যুবদলেরও শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
তবে কিছু তৃণমূল নেতার কর্মকাণ্ডে স্থানীয় বিএনপি বিব্রত। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার মীর ছগিরের মতো নেতা চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও ভয় দেখানোর মতো কাজে লিপ্ত। দলের তদন্তে তার অপকর্মের সত্যতা পাওয়া গেলেও অজ্ঞাত কারণে তাকে বহিষ্কার করা হচ্ছে না। ফলে তার বিরুদ্ধে কেন্দ্রে রিপোর্ট করা নেতারা অস্বস্তি বোধ করছেন।
জানা গেছে, হেভিওয়েট নেতাদের মধ্যে সর্বশেষ ৫ মার্চ বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মাসুদ আহমেদ তালুকদারের সদস্য পদ স্থগিত করা হয়। যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদল সহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, সংগঠনের নাম ব্যবহার করে দখলের কোনো ঘটনা ঘটলে অপরাধীকে ধরে কেন্দ্রে জানানোর জন্য।
এছাড়াও, বিএনপি ঘরানার পেশাজীবী সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানিয়েছেন, দলে যোগদান অনুষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে এবং হাইব্রিড নেতাদের বিষয়ে বিএনপি সতর্ক রয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মূল্যায়নের বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন। এরপরও অনেকে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম করছে, যাদের দলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। বিএনপির দুর্দিনে ত্যাগ স্বীকার করা নেতাকর্মীদের দল মূল্যায়ন করবে।