রাতের আকাশে আতশবাজিগুলাে হলুদ আলাে ছড়িয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। নিচে ফ্লাড লাইটের কৃত্রিম আলােয় ভাসছে দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম। সেখানে বিশ্বজয়ের আনন্দে হলদে পাখি হয়ে নেচে বেড়াচ্ছেন মিচেল মার্শ, গ্লেন ম্যাক্সওয়েলরা। চ্যাম্পিয়ান অস্ট্রেলিয়া

ওয়ানডে ক্রিকেটের পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া। অপূর্ণতা তবু একটা ছিলই। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগের ছয় আসরের কোনােটিতেই যে তাদের ট্রফি উঁচিয়ে ধরা হয়নি! ফাইনালে এর আগে অবশ্য অস্ট্রেলিয়া উঠেছেই মাত্র একবার। ২০১০ সালের সে ম্যাচে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল টি-টোয়েন্টির বিশ্বসেরা হওয়ার স্বপ্ন। | টিম সাউদির বলটাতে রিভার্স সুইপে চার মেরে কাল রাতে ম্যাক্সওয়েলের আনন্দ নৃত্যে মেতে ওঠা যেন অস্ট্রেলিয়ানদের সে অপেক্ষার অবসানেরই ঘােষণা দিল। ম্যাক্সওয়েলকে অবশ্য একা বেশি ক্ষণ নাচতে দেননি মিচেল মার্শ। দৌড়ে এসে তাঁকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন যে ছবিটার ক্যাপশন হতে পারে এ রকম, তুমি একা নাচলে তাে হবে না, ভাই। এই ম্যাচ কিন্তু আমিও জিতিয়েছি!
উইনিং শটটা ম্যাক্সওয়েলের ব্যাট থেকে এলেও | ৭বল বাকি থাকতে অস্ট্রেলিয়াকে বিশ্বজয়ের আনন্দে | ভাসানাের মূল নায়ক আসলে ম্যাচসেরা হওয়া মার্শই। কেইন উইলিয়ামসন-ঝড়ে নিউজিল্যান্ড ১৭২ রান তুলে ফেললেও মার্শ কখনােই এটা মনে হতে দেননি যে ম্যাচটা অস্ট্রেলিয়া হারতেও পারে। ম্যাচ যত শেষের দিকে এগিয়েছে, অস্ট্রেলিয়াও ততই শিরােপার কাছে চলে গেছে। শেষ ৫ ওভারে জয়ের জন্য প্রয়ােজন ছিল ৩৭ রান, শেষ ২ ওভারে সেটি নেমে আসে ১১ রানে। শেষ ওভারে তাে আর যেতেই হয়নি। সাউদির করা ১৯তম ওভারের প্রথম বলে লং অফ দিয়ে মার্শের বাউন্ডারি। আর শেষটা তাে পঞ্চম বলে ম্যাক্সওয়েলের সেই ‘উইনিং বাউন্ডারি’তেই!
বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল দুটি শেষ দিকে রােমাঞ্চ ছড়ালেও ফাইনালে তার ছিটেফোঁটাও লাগতে দেননি মার্শ। দলের ১৫ রানে নিউজিল্যান্ডের বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল দুটি শেষ দিকে রােমাঞ্চ ছড়ালেও ফাইনালে তার ছিটেফোঁটাও লাগতে দেননি মার্শ। দলের ১৫ রানে নিউজিল্যান্ডের পেসার ট্রেন্ট বােল্ট ফিরিয়ে দেন ওপেনারঅধিনায়ক ফিঞ্চকে। দ্বিতীয় উইকেটে আরেক ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নারের সঙ্গে ৯২ এবং তৃতীয় উইকেটে ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গে ৬৬ রানের অবিচ্ছিন্ন দুই জুটিতেই ম্যাচ শেষ করে দেন মার্শ।
তাঁর চার ছক্কা আর ছয় চারে ৫০ বলে অপরাজিত ৭৭ রানের ইনিংসের সামনে ম্লান হয়ে গেছে নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক উইলিয়ামসনের বিধ্বংসী ব্যাটিংও। নিউজিল্যান্ডের ইনিংসের পুরােটাই তাে ছিল কেইন উইলিয়ামস শাে’! ১৭৭.০৮ স্ট্রাইক রেটের ইনিংসে তিন ছক্কার সঙ্গে | বাউন্ডারি ১০টি। দলের ১৭২ রানের ইনিংসে বাকি ব্যাটসম্যানরা যেন শুধু উইলিয়ামসনকে সংগত দিতেই নেমেছিলেন।
পাওয়ারপ্লেতে ১ উইকেটে মাত্র ৩২ রান করা নিউজিল্যান্ডের রান হঠাৎই বেড়ে যায় ১১ থেকে ১৬ | ওভারের মধ্যে। স্টার্কের করা ইনিংসের ১৬তম। | ওভারেই আসে ২২ রান! থার্ড ম্যান দিয়ে মারা চারে। | শেষ হওয়া ওভারটিতে উইলিয়ামসন মেরেছেন
আরও তিন বাউন্ডারি। ছাড়েননি ১৪৪ কিলােমিটার | গতিতে ধেয়ে আসা পঞ্চম বলটাকেও। তৃতীয় বলে মারা ওভারের একমাত্র ছক্কাটি উড়ে গেছে ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগ দিয়ে।
৩২ বলে ফিফটি, বাউন্ডারি মারতে গিয়ে লং অফে স্টিভ স্মিথের ক্যাচ হওয়ার আগে ৪৮ বলে ৮৫ রান। কখনাে ওপেনার মার্টিন গাপটিল, কখনাে গ্লেন ফিলিপস, কখনােবা নিশামকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাটকে তলােয়ার বানিয়েছেন উইলিয়ামসন।
তবে ১৭২ রান করেও যে নিউজিল্যান্ড খুব স্বস্তিতে ছিল, তা নয়। পাকিস্তানের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের কথা মনে রেখে তাে বটেই, টসে জিতলে কী করতে হবে’ নামের অদৃশ্য বইটাও নিশ্চয়ই কাল পড়ে মাঠে এসেছিলেন উইলিয়ামসন! বইয়ে পরিষ্কারভাবেই লেখা| এবারের বিশ্বকাপে দুবাইয়ে হওয়া ১২ ম্যাচের ১১টিতেই জিতেছে পরে ব্যাট করা দল। রাতের ম্যাচগুলােতে সংখ্যাটা ৯-এ ৯।
কাল টস জিতে অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ যখন বললেন, আমরা আগে ফিল্ডিং করব’, তখনই আফসােস ঝরেছিল উইলিয়ামসনের কণ্ঠে, ‘ইশ, টসে জিতলে তাে আমরাও আগে ফিল্ডিংই করতে চাইতাম!’ প্রথমবারের মতাে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠা নিউজিল্যান্ড অধিনায়কের মনে অন্য একটা ভয়ও নিশ্চয়ই তখন। কাজ করে থাকবে। ফাইনালের আগে টুর্নামেন্টে অস্ট্রেলিয়া যত ম্যাচ জিতেছে, সেগুলােও তাে জিতেছে টসে জিতে আগে ফিল্ডিং করেই। একমাত্র ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই দলটা টসে জেতেনি, ব্যাটিংয়ে নামতে হয়েছিল আগে এবং সে ম্যাচে তারা হেরেওছিল।
ফাইনালেও টসই গড়ে দিয়েছে ম্যাচের ভাগ্য এটা বােধ হয় এখন বলাই যায়। বলে ফেলা যায় আরেকটা কথাও। ২০১৫ ও ২০১৯ সালের আসল বিশ্বকাপের পর এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, বারবার বিশ্বজয়ের দুয়ার থেকে ফিরে আসা নিউজিল্যান্ড যেন অন্যকে চ্যাম্পিয়ন করতেই ফাইনাল খেলে। কখনাে অস্ট্রেলিয়া, কখনাে ইংল্যান্ড, আবার কখনাে ওই অস্ট্রেলিয়াই! বিশ্বকাপের ফাইনালটা তাই কেইন উইলিয়ামসনের। দলের জন্য আরও একবার হয়ে থাকল দীর্ঘশ্বাসের অন্য নাম।
মন্তব্য করুন